EN

জীবাশ্ম জ্বালানিতে অতিমাত্রায় নির্ভরতায়

এই অসহনীয় গরমেও বিদ্যুৎ সংকটে বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে

বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমশই বাড়ার কারণে বাংলাদেশের জলবায়ুতেও এখন আগের চেয়ে বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে। কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহারের কারণে জলবায়ুতে কার্বন নির্গমন বাড়ছে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমদানিকৃত গ্যাস, তেল, ডিজেল ও কয়লার মতো ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানিতে অতি নির্ভরতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি হওয়ায় অসহনীয় তাপমাত্রায় মানুষের অস্বস্তি ও ভোগান্তি দুটোই বেড়েছে। শুধু তাই নয় এই জ্বালানি আমদানি ব্যয় মেটাতে ইতিমধ্যেই চাপে থাকা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ আরও বেড়েছে।
সম্প্রতি প্রস্তাবিত ‘সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা (২০২৪-২০৫০)’ অনুযায়ী জীবাশ্ম জ্বালানিতে বাংলাদেশের নির্ভরতা নিকট ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। এই পরিকল্পনায় জ্বালানি আমদানির পরিমাণ আরও বাড়িয়ে গ্যাসের ব্যবহার ২০৫০ সাল নাগাদ ৩৬০% বৃদ্ধি করে মোট বিদ্যুতের ৩০% উৎপাদন করার কথা বলা হয়েছে। আর এলএনজি আমদানি ২০২২ সালের তথ্যানুযায়ী ৪৬ লক্ষ টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে ৪.৯ কোটি টনে দাঁড়াবে৷ এই মহাপরিকল্পনা থেকে এটা সহজেই বোঝা যায় যে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত আবারও জীবাশ্ম জ্বালানির দীর্ঘমেয়াদি দুষ্টচক্রে আটকা পড়তে যাচ্ছে।

জীবাশ্ম জ্বালানিতে নির্ভরতা

আমাদের অর্থনীতি ও পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

জীবাশ্ম জ্বালানিতে অতি নির্ভরতার কারণে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। একইসাথে আন্তজার্তিক বাজারে জ্বালানির দাম ওঠা-নামার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ হুমকির মুখে পড়ছে।

প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থাৎ মোট ২৫,৭০০ মেগাওয়াট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ চরম বিদ্যুৎ সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের ঘাটতিতে শিল্পকারখানার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে, সাথে গরমে ভোগান্তি তো আছেই।

জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানি ব্যয় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে এবং বিদ্যুতের সাথে অর্থনীতিতেও সংকট বেড়েছে।

জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানিতে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয়ের ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি কিংবা সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পেও বিনিয়োগের সুযোগ কমে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের মোট ভর্তুকির ৬% খরচ হয়ে যাচ্ছে, ফলে স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় ক্রমশ কমছে।
জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে জলবায়ুতে কার্বন ও গ্রীনহাউস গ্যাসের নির্গমন বেড়েছে, ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিও বাড়ছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকেও বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের দায় কিছুটা নিতেই হবে। মোট কার্বন নির্গমনের ৫৫% শুধু কয়লা ও গ্যাসের মত জ্বালানির ব্যবহার থেকেই আসছে।
মমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা খুলনার বাসিন্দা।
সমুদ্রের নিকটবর্তী এলাকায় বাতাসে আদ্রর্তার পরিমাণ বেশি হওয়ায় এখানে অসহনীয় গরম। আর বিদ্যুৎ ঠিকমতো না থাকায় গরমে অস্বস্তি আরও বেড়ে যায়, ফলে অসহনীয় গরম থেকে বাঁচতে সবারই কোনভাবে ঘর ঠান্ডা করার চেষ্ঠা করতে হয়
রিদওয়ান নোমানি, বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট এর বাসিন্দা
“অনেক গরমে ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষি জমিতে কাজ করা আমাদের জন্য শারীরিকভাবে ক্ষতিকর। এমনকি দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় আমরা সেচের জন্য পানির পাম্প চালিয়ে কাজ এগিয়ে নিতে পারি না। বিশেষ করে যখন পাম্প চালানো সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়, তখনই এই সমস্যা হয়”
শাহীন হোসেন, গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক
“বিদ্যুৎ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাড়তি দাম, বাড়তি বাড়ি ভাড়া পরিশোধের সময় মনে হয় শহর ছেড়ে গ্রামেই ফিরে যাই। কারণ এই স্বল্প উপার্জন দিয়ে তিন সদস্যের সংসার চালানো আমার জন্য এখন কঠিন।”
**ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বার্থে মন্তব্যকারীদের ছবি প্রকাশ করা হয়নি

জীবাশ্ম জ্বালানির

ঋণের ফাঁদে বাংলাদেশ

জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে বাংলাদেশকে প্রতি বছর ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ করতে হচ্ছে । এর মধ্যে দেড় বিলিয়ন সরকারি খাতে ও বাকি অর্ধ বিলিয়ন বেসরকারি খাতে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (BPDB) এর বিদেশী ঋণসহায়তাকারীদের কাছে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অপরিশোধিত ঋণ জমা হয়েছে, যার জামিনদার বাংলাদেশ সরকার। বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলোর ঋণের অংকটাও বিশাল, ৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়ে এই পরিমাণ ঋণ অর্থনীতিকে বিরাট ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার

বাড়াতেই হবে, এর বিকল্প নেই

মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি’ পরিকল্পনাকে’ বিবেচনায় রেখে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বান্ধব বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতি গ্রহণ করলে তরলীকৃত গ্যাসের আমদানির পরিমাণ বাংলাদেশ ২৫% কমিয়ে ফেলতে পারবে এবং এতে ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ২.৭ বিলিয়ন ডলার সঞ্চয় করাও সম্ভব হবে।
শুধু তাই নয় নির্দেশনামূলক এই জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা মেনে কাজ করলে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বাংলাদেশের অতি নির্ভরতা কমবে এবং জ্বালানি-সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ গড়তেও সহায়ক হবে। আর জ্বালানি-সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হলে পরিবেশগত স্থায়িত্ব বাড়বে এবং ভু্র্তকি ও দামের ওঠা-নামা ছাড়াই সকলের জন্য ন্যায্য মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।