পাঁচ ঝুঁকিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি, প্রধান ঝুঁকি জ্বালানিসংকট: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ জ্বালানিস্বল্পতা। এ কারণে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সেই সঙ্গে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিও অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। অর্থনীতিতে ঝুঁকির অন্যান্য ক্ষেত্র হচ্ছে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া, সম্পদ ও আয়বৈষম্য এবং সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া ও বেকারত্ব। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের বার্ষিক বৈঠকের আগে গতকাল বুধবার বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য ঝুঁকির সাধারণ ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সুনির্দিষ্ট ঝুঁকিগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের প্রসঙ্গে ঝুঁকির উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের ভোগান্তি বাড়াবে

নাগরিক সুবিধার জন্য সরকারকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে জোর দিতে হয়। এ কারণে প্রয়োজনীয় ভর্তুকিও সরকার বহন করে। কিন্তু সম্প্রতি নগদ অর্থের সংকটে ভর্তুকির অর্থ পরিশোধে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিপুল অংকের বিল বকেয়া পড়েছে। বিদ্যুতে ভর্তুকির অর্থের বিপরীতে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে দায় পরিশোধ কিছু সময়ের জন্য বিলম্বিত করা হয়েছে। এ বন্ডের সুদ ও পুঞ্জীভূত ভর্তুকির অর্থ পরিশোধে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার। চলতি শীত মৌসুমেই আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বিদ্যুতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বকেয়া ২১,৪৮১ কোটি টাকা

বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এখনও ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৩০ হাজার ৫৩২ কোটি টাকার ভর্তুকি বকেয়া রয়ে গেছে। এতে বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল নিয়ে বড় ধরনের বিপাকে পড়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। আর নিয়মিত বিল না পাওয়ায় ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে পারছে না রেন্টাল ও আইপিপিগুলো (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার)। বেসরকারির পাশাপাশি সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিলও বকেয়া রয়েছে। এছাড়া পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস বিল এবং ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল বকেয়া রয়েছে। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরের বকেয়ার পরিমাণ ২১ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ভর্তুকি ও বকেয়া বিলের এ চক্র ভাঙতে বন্ড ইস্যু করতে যাচ্ছে সরকার। তবে এ বকেয়ার বিপরীতে প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়া হবে বলে জানা গেছে।

ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করলে বাঁচবে ১১ হাজার কোটি টাকা

ছাদ ব্যবহার করে ২ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব। আর এতে বছরে ১১ হাজার ৩২ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)। এতে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও এর সরবরাহ ব্যাহত হয়। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের অর্থনৈতিক সুবিধা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

জ্বালানি রূপান্তরে দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার

গত তিন দশকে বিশেষত এক দশককালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উল্লেখযোগ্য অর্জনের মাধ্যমে শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করেছে। এরপরও খাতটি একটি কঠিন সময় পার করছে। পাশাপাশি সবার জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা বজায় রেখে জীবাশ্ম জ্বালানির আধিপত্য থেকে জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাতকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি কাঠামোতে রূপান্তরিত করার তাগিদ রয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির আধিপত্যের কারণে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বর্তমানে মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি সংকটের সম্মুখীন।

দেশের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ হাব হচ্ছে সোনাগাজীতে

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানির নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ধরন ও তাদের ক্রমবর্ধমান খরচ নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারকে তীব্রতর করেছে, যা জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস করার অন্যতম উপায়। বিষয়টি মাথায় নিয়ে সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প। ফেনীর সোনাগাজীর চরচান্দিয়া ও চরদরবেশ ইউনিয়নের ২৮৫ একর জমিতে নেওয়া হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। সরকারের উদ্যোগে সবচেয়ে বড় এ প্রকল্পটি চালু হলে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে ৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

সৌর সেচ পাম্প প্রতিস্থাপনে ১৮০ কোটি ডলার প্রয়োজন: বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী

দেশে কৃষি কাজে ব্যবহৃত সৌর সেচ পাম্প স্থাপনে আগামী ২০৩১ সাল নাগাদ ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন (১৮০ কোটি) ডলার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সোমবার (৪ ডিসেম্বর) সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে বিদ্যুৎ বিভাগ আয়োজিত ‘স্কেলিং আপ সোলার ইরিগেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি। নসরুল হামিদ বলেন, ২০৩১ সালের মধ্যে দেশে ৪ লাখ ৫০ হাজার সৌর সেচ পাম্প ইনস্টল করা হবে। বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি পোর্টফলিও, সৌর মিনি-গ্রিড, ভাসমান সৌর বিদ্যুৎ, সৌর পানিয় জলের ব্যবস্থা, সোলার রূপটপ ইনস্টলেশন, সোলার এগ্রো পিভি, সৌর সেচ, বায়ু বিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ প্রভৃতি বৈচিত্র্যময় করেছে।

অল্প গ্যাসে বিশাল ব্যয়

গত ৫ বছরে দেশে শুধু এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। যদিও এই সময়ে দেশের পুরো গ্যাস ক্রয় ব্যবদ ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অথচ মোট গ্যাসের মাত্র ২৪ শতাংশ পাওয়া গেছে এই এলএনজি থেকে। কিন্তু ব্যয় করতে হয়েছে ৭৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ গ্যাসের সমান দাম। এরপরও ব্যয়বহুল এই আমদানি বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার।

এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তায় ঝুঁকি বাড়াবে

আমদানিনির্ভর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভর করে দেশে গড়ে তোলা হয়েছে অনেকগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কিন্তু গত কয়েক বছরে পণ্যটি আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জ্বালানি নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করে জ্বালানি খাতের মার্কিন তথ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল এনার্জি মনিটর (জিইএম)। জ্বালানি সংকটের কারণে বাংলাদেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে। চলমান এসব সংকট নিরসন না হলে ২০২৬ সাল পর্যন্ত ঝুঁকি পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশকে থাকতে হতে পারে।

এলএনজিনির্ভরতা দেশকে বড় বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে?

সরবরাহে স্বল্প অবদান রাখা এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে জ্বালানি বিভাগ। এতে আর্থিক ঝুঁকিতে পড়েছে জ্বালানি খাত। আবার দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে বিনিয়োগ ছিল যৎসামান্য। দেশে গ্যাসের সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় চলমান সংকটের পেছনে বিষয়টি অনেকাংশেই দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই এলএনজিনির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা না গেলে সামনের দিনগুলোয় বিপত্তির মাত্রা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।