বিদ্যুতের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং উপর্যপুরি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট অস্বাভাবিক সংকটের যৌথ আভিঘাত যতোখানি দৃশ্যমান হয় আদতে তার চেয়েও বেশি আক্রান্ত করেছে বাংলাদেশকে।
ইমরান হোসেইন
সংকট তীব্র আকার ধারনের আগেই, অনুরূপ অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ সংকটটিও যে একটি যে বৃহৎ খাদ্য সংকটে পরিণত হতে পারে এবং অবশেষে খাদ্য দাঙ্গা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে তা সম্পর্কে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র এবং ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধগুলি সতর্ক করে দিয়েছিল।
কৃষিবিদরা প্রধান খাদ্য চালসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যদ্রব্যের অনমনীয় উচ্চ মূল্যকে ব্যাখ্যা করেছেন কোভিড মহামারীর মধ্যে খাদ্য সংকট তরান্বিত হওয়ার আগাম সংকেত হিসাবে যা দরিদ্রদের ক্রয় ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলামের মতে, “অনেক দেশ খাদ্য মজুত করছে। বাংলাদেশকেও খাদ্যের ভালো মজুদ গড়ে তুলতে হবে। খাদ্য ঘাটতি দ্রুত মেরুকরণ হতে থাকা বিশ্বকে নাজুক পরিস্থিতে ঠেলে দিতে পারে এবং এই ধরনের সংকটে অর্থ খুব একটা কাজে নাও লাগতে পারে।”
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক মেরুকরণের মধ্যে কোভিড মহামারীর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চাপ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে।
২০২০ সালের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে শক্তি, খাদ্য এবং কৃষি উপকরণের খরচ বহুগুণ বেড়েছে এবং এখনও তার বেড়েই চলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ তার তৈরি পোশাক এবং জনশক্তির বাজার হারানোর ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ায় খাদ্য, জ্বালানি এবং কৃষি উপকরণের আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। এই খাতগুলো বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি।
ছবি: বিদুর জং বাহাদুর/ইউএন উইমেন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক
অর্থনীতিবিদ আবদুল বায়েস বলেন, ‘বাংলাদেশকে অবশ্যই তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি কিছুটা হ্রাস করতে সার্বিক পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের হাতে অনেক সমস্যা, বিশেষ করে সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবেলায় সম্পদ সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে যে আগের বছরের তুলনায় কৃষি উপকরণের বর্ধিত আমদানি ব্যয় মেটাতে চলতি অর্থবছরে তাদের কৃষি ভর্তুকি চারগুণ করতে হবে।
ইউরিয়া এবং নন-ইউরিয়া সারের দাম ২০২১ এবং ২০২২ সালের জানুয়ারির মধ্যে তিন থেকে ছয় গুণ বেড়েছে। যদি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে কৃষি রাসায়নিকের ব্যবহার বৃদ্ধির সম্ভাবনা আরও বেশি বেড়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক মিডিয়া ইতিমধ্যেই উন্নত দেশগুলোর উদ্বেগের কথা জানিয়েছে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা, তাদের কৃষকরা অতিরিক্ত সারের দামের কারণে উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। কিছু কৃষক কম সার-নির্ভর ফসল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে গেছে। প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উত্পাদিত ইউরিয়া যা বাংলাদেশের মোট ব্যবহৃত সারের অর্ধেক, তার দাম ২০১৯ সাল থেকে বেশ কয়েক গুণ বেড়েছে। জ্বালানীর দামের কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির পর অন্যান্য সারের দামও বেড়েছে।
রাশিয়া এবং তার মিত্র বেলারুশ বাংলাদেশের পটাসিয়াম সার বা এমওপি আমদানির অর্ধেকের যোগা দেয়, যা দেশের তৃতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত কৃষি রাসায়নিক। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেলারুশ শেষবার বাংলাদেশে এমওপি রপ্তানি করেছিল গত বছরের নভেম্বরে কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে তার মূল্য পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়।
বিএডিসি কর্মকর্তারা বলেছেন, রাশিয়া এখনও সার সরবরাহে বিঘ্নের বিষয়ে কিছু জানায়নি, তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার সাথে দ্রুত লেনদেন বিঘ্নিত হওয়ায় বাংলাদেশের সার আমদানিতে প্রভাব নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বিএডিসি’র একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘যেভাবেই হোক সার আমদানি ব্যাহত হবে। বাংলাদেশকে নতুন সারের উৎস খুঁজে বের করতে হবে।’
বিএডিসি বলেছে যে তাদের কাছে অক্টোবর পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় সার মজুত রয়েছে এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ততদিনে শেষ হওয়ার বিষয়ে দৃঢ়ভাবে আশাবাদী তারা। এমনকি যদি যুদ্ধটি প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে শেষ হয়, তবুও যুদ্ধরত বা রাজনৈতিকভাবে অস্থির দেশগুলিতে স্বাভাবিকতা ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে।
এখন বিএডিসি কর্মকর্তারা তিউনিসিয়ার উদাহরণ টেনে বলছেন, তিউনিসিয়ায় সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে টিএসপি আমদানি ব্যাহতের জন্য দায়ী। কারণ দেশটি বাংলাদেশে টিএসপি’র প্রধান রপ্তানিকারক ছিল এবং বাংলাদেশের টিএসপি আমদানির এক তৃতীয়াংশের যোগানদাতা ছিল তিউনিসিয়া। বাংলাদেশ টিএসপির জন্য এককভাবে মরক্কোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, দেশে দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত সার, ডিএপি আমদানি গত বছর থেকে কোভিড -১৯ মহামারীর কারণে বিশ্বের একটি প্রধান ডিএপি উত্পাদনকারী দেশ চীনের অপারগতায় উল্লেখযোগ্যভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
জ্বালানীর উচ্চমূল্য এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিশ্বব্যাপী অদূর ভবিষ্যতে সার দুর্লভ না হলেও ব্যয়বহুল থাকবে বলে আশংকা করছেন কৃষিবিদরা।
প্রাকৃতিক গ্যাস ইউরিয়া সারের কাঁচামাল, যা বাংলাদেশে বব্যহৃত বার্ষিক ৫০ লাখ টন সারের অর্ধেক। রয়টার্সের মতে, অক্টোবর ২০১৯ থেকে মার্চ ২০২২ এর মধ্যে এলএনজি স্পট মার্কেটের দাম প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। স্পট মার্কেটে উচ্চ এলএনজি মূল্যের কারণে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সরবরাহকারীরা এই বছর বাংলাদেশে তাদের সরবরাহ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে দাঁড়ায় যখন দেশের দুটি ভাসমান স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের একটির মুরিং লাইন ছিঁড়ে যায়, যার জন্য প্রায় তিন মাস আমদানি ব্যাহত হয়।
গত বছরের নভেম্বরে কৃষি সেচের জন্য ব্যবহৃত জ্বালানির দাম প্রায় এক-চতুর্থাংশ বাড়ানো হয়েছে। কৃষকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হতাশার স্পষ্ট প্রতিফলনে, দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরবঙ্গের দুই কৃষক সম্প্রতি ধানের ক্ষেতে সেচ দিতে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
বাংলাদেশের কৃষকরা, প্রাথমিকভাবে ছোট জমির মালিকরা যারা উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে কাজ করেন, তারা প্রধান শষ্য ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। একটি ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে কৃষকরা অনেক বছর থেকে ক্রমেই ধান চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের কৃষকরাও ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ফসলের ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে। এভাবে স্থানীয় ফসল উৎপাদনে হ্রাস বিপর্যয়কর পরিণতি বয়ে আনতে পারে, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের মধ্যে।
বিশ্বের বৃহত্তম গম আমদানিকারক মিশর ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মতো প্রধান বৈশ্বিক গম উৎপাদকদের যুদ্ধে আটকে যাওয়ার পরে অন্যান্য আমদানি উৎস খুঁজতে ব্যস্ত।
এপ্রিলে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড এগ্রিকারচার সাপ্লাই এন্ড ডিমান্ড এস্টিমেটস রিপোর্ট-এ, মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) বিশ্বব্যাপী গম বাণিজ্যে ৩ মিলিয়ন টন হ্রাসের পূর্বাভাস দিয়েছে।
ইউএসডিএ-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ সালে বাংলাদেশের গম আমদানির ৪২ শতাংশ ছিল ইউক্রেন ও রাশিয়ার। ৭০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে বাংলাদেশে মাত্র ১০ লাখ টন গম উৎপাদন হয়। অতিরিক্ত তাপামাত্রা এবং গমের ব্লাস্ট রোগ বাংলাদেশের গম উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে।
খাদ্য সরবরাহের জন্য গমের উপর পশুপালন ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হওয়ায় বাংলাদেশেও গমের চাহিদা বাড়ছে। ট্রেডিং ইকোনমিক্স ওয়েবসাইট অনুসারে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি বুশেল গমের দাম ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে ৮০০ ডলার থেকে মে মাসে প্রায় ১১০০ ডলারে পৌঁছায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলাম বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব কোন দিকে যাচ্ছে তা আমরা জানি না, তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে দেশগুলো খাদ্য মজুদ করছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই কৃষি উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখার দিকে নজর দিতে হবে।’
এপ্রিলে প্রকাশিত তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে, ইউএসডিএ বলেছে যে বাংলাদেশকে ২০২১-২২ সালে এক কোটি টন চাল, গম এবং ভুট্টা আমদানি করতে হতে পারে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ আবদুল বায়েস বলেছেন, আগামী বছরের শেষের দিকে বা ২০২৪ সালের প্রথম দিকে হতে যাওয়া সাধারণ নির্বাচনের আগে এই সংকটগুলি বর্তমান সরকারকে অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলেছে।
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, সাবধানতার সাথে পদক্ষেপ না নিলে সরকার সমস্যায় পড়তে পারে, ঠিক শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ইতিমধ্যে নিশ্চিত করেছে যে এই অর্থবছরে আমদানি ব্যয় আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে বৈদেশিক রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৭ শতাংশের বেশি কমেছে। অন্যদিকে রপ্তানি বাজার সংকুচিত হচ্ছে। যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়া ও ইউক্রেনে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের।
তবুও, উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশকে অনিশ্চিত মনে হয়েছে এবং একটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির পর জাতীয় বাজেটের এক তৃতীয়াংশ, যা বাজেট ঘাটতির সমতুল্য, ব্যয় করার পরিকল্পনা করছে। বিদ্যুৎ খাতের ক্রমবর্ধমান ব্যয় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারসাম্যহীন করছে। যখন আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজার দাম এখনো উচ্চ এবং অস্থির রয়ে গেছে, তখন অচল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রদানের পরিমাণ বিদায়ী বছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে দ্বিগুণ হয়ে ২৬,০০০ কোটি টাকার বেশি হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। পাঁচ দিন আগে একটি সরকারি কারিগরি কমিটি ইতিমধ্যেই বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল, একই কমিটি গ্যাসের দাম ২০ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করার প্রায় দুই মাস পরে।
বিদ্যুৎ নীতি বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে আগামী বছরগুলিতে বাংলাদেশে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি পুনরাবৃত্তি হতে পারে, যা জনগণের অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।