নিউজলেটার

EN

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ কেন এত কঠিন

প্রায় আড়াই বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন না পাওয়ায় বাংলাদেশে একটি ১০০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিলের কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি এলেরিস এনার্জি গ্লোবাল। বাংলাদেশ আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের (সেনা কল্যাণ সংস্থা) সঙ্গে যৌথ প্রকল্পে যাওয়া মার্কিন এ কোম্পানিটি তার ২৫ বছর মেয়াদি ১৭৯ কোটি ডলারের সৌর প্রকল্পের জন্য ৫ হাজার একর জলাভূমি লিজ নিয়েছিল। উপকূল সংলগ্ন একটি দ্বীপে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হওয়ার কথা ছিল।

ইমরান হোসেন

নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশে বাধাসমূহ

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যৌথ প্রকল্পে ঢোকার পর এলেরিস তাদের প্রকল্পের উন্নয়নে এখন পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকার মতো খরচ করে ফেলেছে; তাদের প্রকৌশলীরা দেশে-বিদেশে কাজও করে চলেছে।

“আমরা বুঝতে পারছি না আমাদের সঙ্গে হচ্ছেটা কী? শেষ পর্যন্ত অনুমোদন পাবো কি পাবো না সেটা জানি না আমরা,” বলেছেন প্রকল্পটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন খান। যৌথ এই প্রকল্পটির সঙ্গে জড়িতদের আশঙ্কা, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে অনুমোদন না মিললে এই সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাতিলও হয়ে যেতে পারে।

বৃহদাকার একটি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে অনুমতি পাওয়া মার্কিন কোম্পানিটির জন্য কেন এত কঠিন, তা চিহ্নিত করা খুবই কষ্টকর; অথচ এমন প্রকল্প বিদ্যুতের উৎসগুলোর মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির অংশীদারিত্বের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের যে প্রতিশ্রুতি আছে তা পূরণে বড় ধরনের সহায়ক হতে পারতো।

এ ধরনের অনেক বাধাই বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশ ঠেকিয়ে রেখেছে।

আমাদের নবায়নযোগ্য শক্তির লক্ষ্যমাত্রা কোথায় দাঁড়িয়ে?

আমাদের এখন স্থাপিত কেন্দ্রগুলোর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে হলেও তাতে নবায়নযোগ্য শক্তির অবদান মাত্র ৩ শতাংশ। এই মোট উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে আবার প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকে যোগ করা হয়নি; নিজেদের ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন কারখানা জীবাশ্ম জ্বালানির সাহায্যে এই ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

বাংলাদেশ বারবারই তার নবায়নযোগ্য শক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। কথা ছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫ শতাংশ আসবে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে, ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ।

বছরের পর বছর ধরে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প বিশেষ করে বৃহদাকার সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে জমির অভাবকে বড় বাধা হিসেবে দেখানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষও কেবল ভবনের ছাদে-ই সৌর বিদ্যুতের সম্ভাবনা দেখেছে আর বলেছে, বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনা খুব একটা নেই। এরপরও ছাদে এবং সেচে সৌর বিদ্যুতের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি, যার পেছনে বৈষম্যমূলক অর্থায়ন নীতির বড় ভূমিকা আছে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

অন্যদিকে সেই একই বাংলাদেশ, তার জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ ‍উৎপাদন বাড়িয়েই চলেছে, ঋণে সার্বভৌম গ্যারান্টি দিচ্ছে, জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাতে যতটুকু দরকার, তার চেয়ে অনেক বেশি জমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছে, ক্যাপাসিটি চার্জের সাহায্যে মোটা অঙ্কের লাভেরও নিশ্চয়তা দিচ্ছে। এসবের কারণে ২০০৯ এর পর থেকে জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩০০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ এমনকি জীবাশ্ম-জ্বালানি বিস্তৃতির সুরক্ষায় ইনডেমনিটি আইনও পাস করে রেখেছে, যার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নিলাম ছাড়াই বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন করা যায়। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নিলাম, যাকে সুরক্ষা দিচ্ছে কুইক এনহান্সমেন্ট অব ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড এনার্জি সাপ্লাই অ্যাক্ট ২০১০ এর মতো ইনডেমনিটি আইন, এমন এক বিতর্কিত ব্যবস্থাপনার বিকাশ ঘটিয়েছে যাতে অংশগ্রহণে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগকারী অভিজ্ঞ ও বৃহৎ কোম্পানিগুলো রাজি নয় বলে পর্যবেক্ষণ জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের।

অস্বচ্ছ অনুমোদন প্রক্রিয়া

গত বছরের এক প্রতিবেদনে চেইঞ্জ ইনিসিয়েটিভ নামের একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা বিদ্যমান, তার কয়েকটি তালিকাভুক্ত করেছিল। এর মধ্যে রয়েছে- অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রিতা, জমি অধিগ্রহণে সমস্যা, বিদ্যুতের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নিলাম, মুদ্রার ওঠানামা এবং বিদ্যুতের বাজারে অস্থিতিশীলতা।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ- সোয়াসের নেতৃত্বাধীন দুর্নীতিবিরোধী একটি গবেষণা ও তথ্যউপাত্তভিত্তিক কনসোর্টিয়াম মার্চে এক প্রাথমিক ধারণাপত্র প্রকাশ করেছে যাতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো যে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত হয় তা বেরিয়ে এসেছে। ধারণাপত্রে ‘সিন্ডিকেট’ ও ‘পরামর্শদাতা’দের অস্তিত্বের কথা উঠে এসেছে, যাদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিতে জড়িত ব্যক্তি এবং সাংবাদিকরাও রয়েছে, যারা পর্দার আড়ালে বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো নিয়ে দরকষাকষি করেন। এই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অনুমোদন পেতে যে কাউকেই তাই অনানুষ্ঠানিক উপায়ে অগ্রসর হতে হয়।

সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে থাকা এই অনুমোদন প্রক্রিয়ার ফলে বিদ্যুতের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়, যে কারণে নবায়নযোগ্য শক্তির সাহায্যে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের মতোই দামি হয়ে ওঠে, যার পরিণতি হয় খুবই খারাপ, ধারণাপত্রে এমনটাই দেখানো হয়েছে।

‘এর পরিণতি খুবই খারাপ হওয়ার কথা, কেননা একবার ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক যোগসাজশের মাধ্যমে কী করে সিন্ডিকেটকে পোষ মানাতে হয় তা বুঝে ফেলে এবং অনুমোদনের জন্য টাকা খরচ করে, তারপর আর তাদেরকে বিদ্যুতের বেশি দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে আটকানো যায় না, যে দামে কেবল অনানুষ্ঠানিকভাবে করা খরচই উঠে আসে না, অতিরিক্ত লাভও হয়,’ ধারণাপত্রের এক অনুচ্ছেদে এমনটাই বলা হয়েছে।

শক্তিশালী রাজনৈতিক যোগসাজশ নেই এমন সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতে পারে, বলা হয়েছে ওই ধারণাপত্রে।

‘রাজনৈতিক যোগসাজশহীন বিনিয়োগকারীরা উচ্চ বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখোমুখি হয়ে এ খাত থেকে দূরে থাকে; যার ফলে বিদ্যমান বিনিয়োগকারী ও সরকারি কর্মকর্তাদের যে সংঘবদ্ধ অংশ সেটা জবাবদিহিতা এড়িয়ে যেতে পারে, এ কারণে বিদ্যুতের দামও বেড়ে যায় যা বিদ্যুৎ খাতের আর্থিক উপযোগিতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়, এটা রাজনৈতিক যোগাযোগ নেই এমন বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়, এভাবেই চলছে,’ বলা হয়েছে প্রাথমিক ধারণাপত্রে।

২০০৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুতের দাম তিনগুণ বাড়তে দেখেছে। এখানে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও অন্যান্য দেশ থেকে অনেক অনেক বেশি।

বাংলাদেশে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গড় মূলধনী খরচ যে বৈশ্বিক গড়ের দ্বিগুণ তা ২০১৮ সালে প্রকাশিত অন্য এক গবেষণায় উঠে এসেছিল। ওই গবেষণায় চলমান ও পরিকল্পনায় আছে এমন ৬১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের খরচ খতিয়ে দেখা হয়েছিল।

এ ধরনের অস্বচ্ছ চুক্তির ফলে বাংলাদেশে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম হয় চড়া, যার কারণে বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ভর্তুকি দিতে হয়, যা শেষ পর্যন্ত করদাতাদের ঘাড়েই পড়ে।

সোয়াসের ওই ধারণাপত্রে যে আনুমানিক হিসাব দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা গেছে বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোতে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ভারতের তুলনায় ৩.৮৭ গুণ এবং বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের ‍তুলনায় ১.৪৭ গুণ বেশি।

নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে দক্ষতার ঘাটতি

দামে কারসাজি আর মোটা অঙ্কের মুনাফা করার সুযোগ থাকায় অনেক অনভিজ্ঞ, রুগ্ন কোম্পানি বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তির বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশের জায়গা ধ্বংস করে দিচ্ছে।

যারা ইতিমধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমোদন পেয়েছে তাদের মধ্যে পোল্ট্রি, পশু খাদ্য প্রস্তুতকারক ও আবাসন ব্যবসায়ী, স্থাপনা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, তৈরি পোশাক, শিক্ষা ব্যবসায়ী এমনকি জনশক্তি রপ্তানিকার প্রতিষ্ঠানও স্থান পেয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাশ্রয়ী মূল্যে সৌর, বায়ু ও হাইড্রো বিদ্যুৎ পেতে কোনো মানসম্পন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিস্তৃত জ্ঞানের প্রয়োজন, বিশেষত বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে, যেখানে জমির ঘাটতি রয়েছে। এখানে যে কোনো ধরনের অবকাঠামোর বিস্তৃতিতে কৃষিজমি কমে যাওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।

নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বেশি অপেশাদার বিনিয়োগকারীর উপস্থিতি অংশত এই ব্যাখ্যা-ই দেয় যে কেন ২০০৮ সালে নবায়নযোগ্য শক্তি নীতি নেওয়ার পরও গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে একটিও মানসম্পন্ন নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবসায়ীদের একটি প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি এসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা দিপল বড়ুয়া বলেছেন, ভালো মুনাফা করার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও স্বচ্ছতা নেই এমন যে কোনো কিছুতে জড়াতে চায় না খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলো। 

একটি নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প আলোর মুখ দেখতে হলে কোনো একটি কোম্পানিকে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের কাছে তার আগ্রহ প্রকাশ করা লাগে, সঙ্গে থাকতে হয় জমির প্রাপ্যতার প্রমাণসহ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প পরিকল্পনা। মন্ত্রণালয় ওই প্রস্তাব যাচাই বাছাই করে, যা শেষ হওয়া নির্ভর করে ওই কোম্পানি সংঘবদ্ধ চক্রের অনুমোদন প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে পারে কিনা তার ওপর।

নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই তাই বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে পিপিএ (বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি) করতেই বছরের পর বছর পার হয়ে যেতে পারে।

বিপিডিবির তালিকায় থাকা ৭৫টি প্রকল্প (যার মধ্যে ১০টি চলমান) পর্যালোচনা করে দেখা গেছে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে ব্যবসা করছে এমন অনেক কোম্পানির এর আগে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও সরকারের অনুমোদন জোগাড়ে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।

যেমন ধরা যাক, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কথা। সাভারভিত্তিক এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। এই হাসপাতালটি আরও দুটি চীনা কোম্পানির সঙ্গে মিলে গত নভেম্বরে ফেনীতে একটি ১০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের অনুমোদন পেয়েছে; তারা ইউনিটপ্রতি ১১টাকা দরে বিদ্যুৎ বেচবে।

এরকম আধডজন টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট কোম্পানি, একাধিক নির্মাণ কোম্পানি, আবাসন ব্যবসায়ী, কৃষি-পণ্য বিক্রেতা এবং একটি মোটর সাইকেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প স্থাপনে অনুমোদন পাওয়া কোম্পানির তালিকার মধ্যে আছে।

এমনকি একটি রিক্রুটিং এজেন্সিও বান্দরবানে একটি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের অনুমোদন পেয়েছে। তাদের আরও দুই অংশীদার আছে, যাদের একটি আবার চীনের। ২০২০ সালে বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি ও প্রশিক্ষণ কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালে ২৫ বছর বা তার বেশি সময় ধরে জনশক্তি রপ্তানি করেনি এমন ১৫০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছিল, সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া ওই রিক্রুটিং এজেন্সিও এই তালিকায় ছিল।

ফু-ওয়াং বোলিং অ্যান্ড সার্ভিসেস নামের আরেকটি কোম্পানিও বিপিডিবির তালিকায় আছে, যারা পঞ্চগড়ে একটি ৪৭ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন পেয়েছিল। ওই সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পটি আপাতত স্থগিত আছে, বাতিল হয়নি। ঢাকাভিত্তিক ফু-ওয়াং ক্লাবের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে ৪১ কোটির বেশি ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল।

চীনা কোম্পানি শুনফেং ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডেরও দুটি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প আছে। এর একটি ২০২১ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনও শুরু করে। এরও চার বছর আগে কোম্পানিটি অনুমোদন পায়, পিপিএ স্বাক্ষর হয় প্রায় আড়াই বছর আগে। ঋণে জর্জরিত হয়ে এই শুনফেং-ই ২০১৯ সালে তাদের একটি সহায়ক প্রতিষ্ঠান বিক্রি এবং বিদেশে কার্যক্রম তুলে রাখার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিল বলে জানাচ্ছে ব্যবসা সংক্রান্ত খবর ও বাজারভিত্তিক তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রিনিউয়েবলস নাও। চীনা কোম্পানিটির অন্য সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুমোদন পেয়েছিল, যদিও আগামী বছরের জুনের আগে এটি উৎপাদনে যেতে পারবে না।

সব ঠিকঠাক থাকলে ১৩ মাসের মধ্যেই একটি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইকোলজি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সদস্যসচিব হাসান মেহেদি। একটি মানসম্পন্ন প্রকল্পের দুটি অপরিহার্য উপাদান থাকে বলেও ব্যাখ্যা করেন তিনি। এগুলো হচ্ছে- বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্য সরবরাহ এবং মানসম্পন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবহার।

রংপুরের ৩০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পটি উৎপাদনে যায় ২০২২ সালে, অনুমোদন পাওয়ার প্রায় ৮ বছর এবং পিপিএ স্বাক্ষরিত হওয়ার ঠিক ৫ বছর পর।

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একইরকম দীর্ঘসূত্রিতা দেখতে হয়েছিল। গাইবান্ধার ওই ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পটি উৎপাদন শুরু করে গত বছরের জানুয়ারিতে, অনুমোদন পাওয়ার ৮ বছর পর। পিপিএ স্বাক্ষরিত হওয়ার ৫ বছরেরও বেশি সময় পর প্রকল্পটি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে পেরেছিল।

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার ৩২ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছিল ২০১৫ সালে; পিপিএ স্বাক্ষরিত হওয়ার ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারেনি।

নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প নির্মাণে জড়িত দেশসমূহ

বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়া প্রকল্পগুলোসহ যে ৭৫টি নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প আছে, সেখানে সবমিলিয়ে ১২টি দেশ জড়িত, এ সব প্রকল্পের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪৮৯.৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে চীন একাই ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যেগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা ১৬০১ মেগাওয়াট।

বাংলাদেশ জড়িত ১২৫৮ মেগাওয়াট নির্মাণে, এরপর সিঙ্গাপুর, তাদের সহ-অর্থায়নে হওয়া সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর মোট সক্ষমতা ৭২৮ মেগাওয়াট। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সহ- অর্থায়নে ৪৭০ মেগাওয়াট, জাপানের ৪০০ মেগাওয়াট, ভারতের ২৫০ মেগাওয়াট। এর বাইরে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য ও কোরিয়া প্রত্যেকটি দেশের সহ-অর্থায়নে ১০০ বা তার চেয়ে কিছু বেশি মেগাওয়াটের প্রকল্প আছে।

নরওয়ে, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো যেসব সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে, সেগুলো প্রত্যেকটির সক্ষমতা মাত্র ৫০ মেগাওয়াট। অনুমোদনপ্রাপ্ত কয়েকটি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প কেবল পিপিএ স্বাক্ষর করার জন্যই ৬ বছর ধরে অপেক্ষা করছে।

এই অনুমোদিত প্রকল্পগুলোতে বিদ্যুতের দর ঠিক হয়েছে ৭.৬৮ থেকে ২০.৮৭ টাকার মধ্যে। গড়ে দাম পড়েছে ইউনিটপ্রতি ১০টাকা। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য শক্তি সংস্থা বিশ্বব্যাপী সৌর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ইউনিটপ্রতি ৫ দশমিক ৪২ টাকা হতে পারে বলে ধারণা দিয়েছিল। ২০১০ সালের পর থেকে ওই বছর পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ৮৯ শতাংশ, আর বায়ু বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ৬৯ শতাংশ কমেছে বলেও সেসময় জানিয়েছিল তারা।
২০২৩ সালে সৌর বিদ্যুতের দর জাপানে ইউনিটপ্রতি ৫.৮ আর ভারতে ৩.০৪ টাকায় নেমে আসে।

ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল এনালিসিসের জ্বালানি বিষয়ক মুখ্য বিশ্লেষক শফিকুল আলমের অনুমান, বাংলাদেশে প্রতি ইউনিট সৌর বিদ্যুতের যৌক্তিক দাম হওয়া উচিত ৮.৫ টাকা, আর সরকার সামান্য কিছু পদক্ষেপ নিলে এটা কমে ৬.৫ টাকায় নেমে আসতে পারে। সরকার যদি নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে এবং উৎপাদনের পর সেই বিদ্যুৎ ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে তাহলে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর মূল ব্যয় অনেকটাই কমে আসবে, বলেছেন তিনি।

জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ নিতে সরকার নিজেই সঞ্চালন লাইন বানাচ্ছে। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে বিনিয়োগকারীদের উল্টো তাদের বিদ্যুৎ ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হয়, কেননা বেশিরভাগ সময়ই তাদের কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রিড থেকে অনেক দূরে থাকে।

উচ্চ আমদানি শুল্ক

নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি সরকারের নীতি যে বৈষম্যমূলক, ছোট প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য সৌর প্যানেল আমদানির ক্ষেত্রে থাকা উচ্চ শুল্কেই তা স্পষ্ট। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই শুল্ক ১১ শতাংশ থেকে দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে ২৬ শতাংশ করা হয়।

সৌর প্রকল্পের ক্ষেত্রে অন্যতম মূল উপাদান ইনভার্টার আমদানিতে ৩৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়, যদি সেই ইনভার্টার ছোট প্রকল্পে ব্যবহারে জন্য হয়। সৌর প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম আমদানিতে দিতে হয় ৫৮.৬ শতাংশ শুল্ক, প্রকল্পে আনুষঙ্গিক হিসেবে ওয়াকওয়ে আমদানিতেও দিতে হয় ১৫.২৬ শতাংশ শুল্ক, বলছেন নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগকারীরা।

নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে আমাদের যে উল্লেখযোগ্য অর্জন, যেটার মাধ্যমে ১৯৯০ সালের পর ৬০ লাখেরও বেশি ঘরে সৌর ব্যবস্থাপনা স্থাপিত হয়েছিল, বাংলাদেশ ১০০ শতাংশ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন করার পর সেই অর্জনও হারিয়ে গেছে।

নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ

নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পে ঋণ দিতে ব্যাঙ্কগুলোকেও অনাগ্রহী দেখা যায়, কেননা জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্পগুলোর তুলনায় এসব প্রকল্পে লাভ উঠে আসতে অনেক বেশি সময় লাগে।

ব্যাংকিং বাদে অন্যান্য আর্থিক খাতও নবায়নযোগ্য প্রকল্পে বিনিয়োগকে খুব একটা লাভজনক মনে করে না।

নবায়নযোগ্য শক্তিতে অর্থায়নের বড় উৎস হচ্ছে সরকার-মালিকানাধীন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল), যেটা ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ইডকল ঋণ দেয় চড়া সুদে, যা ৯ শতাংশ পর্যন্ত হয়; যে হারে তারা দাতাদের কাছ থেকে তহবিলের একাংশ নিতে পারে, এটি তারচেয়েও বেশি।

একটি বেসরকারি প্রকৌশল, ক্রয় ও নির্মাণ কোম্পানির (ইপিসি) এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে চেইঞ্জ ইনিসিয়েটিভের ধারণাপত্রে ইডকলকেও নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প অনুমোদনে জড়িত ‘সিন্ডিকেটের’ অংশ, এবং প্রকল্প অনুমোদনের অগ্রগতি সহজ করার ক্ষেত্রে দরকষাকষিতে ইডকলও ভূমিকা রাখতে পারে বলে বলা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ইডকলের সঙ্গে কাজ করা আরেক ইপিসি কর্মকর্তাও অভিযোগ জানিয়ে বলেছেন, অনুমোদনের জন্য বিধিবহির্ভূত চর্চায় থাকতে না পেরে তারা ইডকল থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ‍দুর্নীতি দমন কমিশন ২০১৮ সালেই ইডকলের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছিল, জানানো হয়েছে চেইঞ্জ ইনিসিয়েটিভের ওই ধারণাপত্রে।

 

Related Analysis

জ্বালানি সংক্রান্ত নীতিমালাগুলোর অসামঞ্জস্যই বাংলাদেশে নবানোযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণে বাধা

বাংলাদেশের জ্বালানি সংক্রান্ত নীতিমালাগুলোতে, বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা সংক্রান্ত দলিলপত্রে বিপুল অসঙ্গতি রয়েছে, যা

Read More »