চড়া মূল্যস্ফীতি চলছে প্রায় দুই বছর ধরে; নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে তাগাদা বিনিয়োগকারীদের। মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে বাংলাদেশের গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত এক এলাকায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের তিন সদস্যের মৃত্যু হয়। তাদের প্রত্যেকের বয়স ছিল ৫০ এর ঘরে। তিনজনেরই মৃত্যু এমন নাটকীয়ভাবে হয়েছে যে, তা ক্ষুদ্র ওই নৃগোষ্ঠীটির সদস্যদের মনে বড় ধরনের দাগ কেটেছে। এই মৃত্যুগুলোর সঙ্গে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের ধকল ও মানসিক চাপের কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে বলেই ধারণা করছে তারা।
“লোকজন কী পরিমাণ চাপে আছে তা আমি জানি। তারা আর এই চাপ নিতে পারছিল না,” বলেছেন সাঁওতালদের ভূমির অধিকার নিয়ে সোচ্চার সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার কমিটির প্রেসিডেন্ট ফিলেমন বাস্কে।
ইমরান হোসেন
নিদারুণ অর্থনৈতিক সংকট
দুই বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সাল থেকেই মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ চোখ রাঙাচ্ছে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর দাপট ও ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা পরবর্তী পরিস্থিতির মধ্যে একের পর এক গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের অবস্থাকে দিন দিন খারাপ থেকে চরম খারাপের দিকে নিয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক দুর্দশার ফলে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গরিব মানুষ কেবল তাদের খাদ্য তালিকা থেকে প্রতিনিয়ত প্রোটিনই কমাচ্ছে না, এমনকী সন্তানদের স্কুল থেকেও ছাড়িয়ে নিচ্ছে বলে একাধিক স্বতন্ত্র গবেষণায় উঠে এসেছে।
গত বছর বাংলাদেশে তিনবার বিদ্যুতের দাম আর একবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল। চলতি বছর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ফের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হল। সামনের মাসগুলোতে আরও দাম বাড়বে বলে গুঞ্জন আছে। এমনটা হলে অনেকের জন্যই জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করা একপ্রকার অসম্ভবই হয়ে দাঁড়াবে।
গেল কয়েক বছর একের পর এক দুর্যোগ সাধারণ জনগণের জীবন ও জীবনযাত্রাকে ফ্যাকাশে করে দিয়েছে। অনেকেই কোভিড-১৯ এ হারানো চাকরি আর ফিরে পাননি। এদিকে জিনিসপত্রের দাম তো আর বসে থাকছে না, কেবলই চড়ছে; বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রায় থাকে না বললেই চলে। এখানে ব্যবসায়ীরা প্রত্যেক সংকটের সময় কারসাজির মাধ্যমে জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগিয়ে আসছেন।
ওষুধ থেকে শুরু করে চাল, অতি-জরুরি কিংবা তেমন জরুরি নয়, সব পণ্যই এখন আগের চেয়ে দামি হয়ে উঠেছে। সবমিলিয়ে এখনকার অর্থনৈতিক সংকট এরই মধ্যে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বাজে পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
এই সংকটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংক্রান্ত ভুল নীতিরও দায় আছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংক্রান্ত এই ভুল নীতির ফলে জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করতে গিয়ে রিজার্ভে টান পড়ছে, আর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে অহেতুক বিশাল খরচ বহন করতে হচ্ছে।
সমন্বিত বিদ্যুৎ জ্বালানি মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি) ও খরচের বোঝা
সম্প্রতি সরকার যে সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা (ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টার প্ল্যান) গ্রহণ করেছে তার রূপরেখা অনুযায়ী চললে ভবিষ্যতে কখনোই সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই আইইপিএমপি বাস্তবায়িত হলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকেন্দ্রীক খরচের বোঝা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে।
বারবার বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর পেছনে সরকারের যুক্তি হচ্ছে, তারা আর বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দিতে চায় না। এদিকে ব্যয়বহুল জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর মতো বিকল্প সরকারের হাতে রয়েছে। তা সত্ত্বেও তারা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধিকেই যুক্তিযুক্ত মনে করছে।
বাংলাদেশের এখন স্থাপিত কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট, যার অর্ধেকই অলস বসে আছে। ২০২৭ সালের মধ্যে এর সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক আরও ১১ হাজার ৪৮০ মেগাওয়াট যুক্ত হবে, স্বাভাবিকভাবেই যা জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়াবে।
গ্রামীন জনগোষ্ঠীর ওপর এর প্রভাব
“আমি বলবো, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ইতিমধ্যেই নীরব দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে,” দেশের সবচেয়ে অনুন্নত এলাকাগুলোর একটিতে জীবন কেমন, সে সম্বন্ধে বলতে গিয়ে এ মন্তব্যই করেছেন ফিলেমন বাস্কে।
তিনি তার মাথা থেকে প্রতিবেশী কেরিনা হাঁসদার মৃত্যুর কথা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলেন না। ৯ মার্চ মারা যাওয়া ৫২ বছর বয়সী কেরিনা উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়বেটিসে ভুগছিলেন। ‘ঋণ ক্রমাগত বাড়ছে’, এই চিন্তা জীবনের শেষ দিনগুলোতে তাকে বেশ ভুগিয়েছে। যেদিন তার মৃত্যু হয়, সেদিন তিনি অনেকক্ষণ নিজের উঠানে বসে ছিলেন। বিকালের দিকে ‘ভালো লাগছে না’ বলে জানান, এরপর উঠান থেকে বাড়িতেও ঢুকতে পারেনি, কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যান।
ফিলেমন একজন গ্রাম্য চিকিৎসকও, তিনি পৌঁছানোর আগেই প্রতিবেশী কেরিনা না ফেরার দেশের বাসিন্দা হয়ে যান। কেরিনার কয়েক ঘণ্টা আগে মোটর সাইকেল চালানোরত অবস্থায় মারা যান ৫৫ বছর বয়সী লাসারাস টুডু; ওই মোটর সাইকেলে লাসারাসের সঙ্গে তার ছেলেও ছিল।
ছেলে দিনাজপুরের বোর্ডিং স্কুলে যাবে, তাকে বাস স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আসার কথা ছিল লাসারাসের। সেই শেষ যাত্রা। চলন্ত মোটর সাইকেল থেকে লাসারাসের মৃতদেহ গড়িয়ে পড়ে; ছেলে সামান্য আহত হলেও সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যায়।
এর ছয়দিন আগে, গত ৩ মার্চ, শস্যক্ষেতে কর্মব্যস্ত দিন কাটিয়ে বাড়ি ফেরার পরপরই মারা যান ৫৫ বছর বয়সী পিটার মুর্মু। তিনি এক গ্লাস পানি চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটি পান করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেননি, তার আগেই মৃত্যু হয় তার।
সাঁওতালরা মোটাদাগে কৃষক। সে কারণে বাংলাদেশের অনেক কৃষকের জীবনযাত্রার সঙ্গে তাদের মিল পাওয়া যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমাগত তাদের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, ফসল বিক্রি করে তেমন লাভ পাচ্ছেন না, এদিকে উৎপাদন খরচও মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, এসব বিবেচনায় কৃষকরা ক্রমেই চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
উদাহরণস্বরূপ, এক বস্তা ইউরিয়া সারের কথাই ধরা যাক। সাধারণত এক বস্তায় ৫০ কেজি সার থাকে। এই বস্তার দাম গত বছরের মার্চেও ছিল ৯৫০ টাকা, এক বছরের মাথায় সেটি এখন ১৩০০ টাকা। চলতি বছরের মার্চে টিএসপি সার (ট্রিপল সুপার ফসফেট) কিনতে হয়েছে বস্তাপ্রতি ১৯০০ টাকায়, অথচ গত বছরও এর দাম ছিল ১৩৫০ টাকা। এদিকে কৃষিশ্রমিক আর পরিবহন খরচও বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত।
সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি ও কৃষকদের ওপর এর আর্থিক প্রভাব
ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ নিয়ে গত বছরের জানুয়ারি থেকে মোট চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ল। ২০২২ এর জুনের পর গ্যাসের দাম বেড়েছে তিনবার; এর মধ্যে একবার এক ধাক্কায় ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল। ২০২২ সালের অগাস্টে জ্বালানি তেলের দামও সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল।
সরকারি হিসাবেই ২০২২ সালের দ্বিতীয়ভাগে গড় মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সালের প্রথমভাগ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ শতাংশের আশপাশে। কিন্তু ২০২২ সালের জুনে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর অগাস্টেই গড় মূল্যস্ফীতি পৌঁছায় ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে। চলতি বছরের জানুয়ারিতেও মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
২০২২ সালের পর থেকে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কখনোই ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। বিদ্যুতের দাম সম্প্রতি ৮.৫% এবং গ্যাসের দাম ৫% বাড়ানোর পর মূল্যস্ফীতি এখন আরও উঁচুতে চড়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) বলছে, গ্যাস-বিদ্যুতের সাম্প্রতিক এই মূল্যবৃদ্ধি অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে কৃষি খাতে। যার মানে হচ্ছে সামনে কৃষিজাত পণ্য আরও দামি হয়ে উঠবে।
মাসে ৫০ ইউনিট বা তার কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী, যারা ‘লাইফলাইন গ্রাহক’ হিসেবে পরিচিত, গত বছরের জানুয়ারি থেকে তাদের বিদ্যুৎ ব্যবহারে খরচ বেড়েছে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এই ‘লাইফলাইন গ্রাহকরা’ জনসাধারণের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র অংশ। আর একই সময়ের ব্যবধানে ধনী গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত শিক্ষা খাত, বাণিজ্যিক খাত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা এবং সেচ কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচ এক পঞ্চমাংশ বেড়েছে।
বিপাকে কোটি মানুষ
বাণিজ্যিক খাতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচ ধারাবাহিকভাবে বাড়ায় এর প্রভাব কোটি কোটি মানুষের ওপর পড়েছে। বিশেষ করে শহরের বাসিন্দাদের ওপর, যাদের অনেকেই খাবারের জন্য রেস্তোরাঁর ওপর নির্ভরশীল। ঢাকায় নিঃস্ব মানুষদের খাওয়ানো হয়, এমন জায়গাগুলোতে ক্ষুধার্ত মানুষের দীর্ঘ সারি রাজধানীর দরিদ্ররা যে মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভয়াবহ দুর্দশায় পড়েছে তার সাক্ষ্য দিচ্ছে।
খরচ কমাতে এবং আয় বাড়াতে অনেক রেস্তোরাঁ এখন আগের তুলনায় বেশি বাসি ও নষ্ট খাবার সরবরাহ করছে বলে অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ উদ্বেগ তৈরি করেছে।
সাম্প্রতিক গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি পরিবারগুলোর খরচ গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় ৯ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়াবে বলে ধারণা দিয়েছে সিপিডি। বিদ্যুতের জন্য এখন প্রতিটি পরিবারকে ন্যূনতম ১১৮ টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যেক্তাদের বিদ্যুতের খরচ বাড়তে পারে ৯ দশমিক ১২ শতাংশ পর্যন্ত; ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অফিসে বাড়তে পারে ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ। ১০ শতাংশ খরচবৃদ্ধি দেখতে পারে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো; সেচে খরচ বাড়তে পারে ১১ শতাংশের মতো। এর ফলে ধাতু এবং ধাতুজাত পণ্য, খনিজ, সার, রাসায়নিক পদার্থ, আসবাবপত্র, কাচ, কাগজ, মণ্ড ও সিমেন্টের মতো যেসব পণ্য বিদ্যুতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল সেগুলোর দাম বেড়ে যাবে বলে অনুমান সিপিডির।
এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সরকার যে বলছে, ভর্তুকি কমাতেই তারা নিয়মিত দাম বাড়াচ্ছে তা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর। নিজেদের ব্যর্থতা এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎখাতে নেওয়া ভুলনীতির দায় তারা জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ সিপিডির।
জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর
নিজেদের ত্রুটিপূর্ণ নীতি এবং বিদ্যুতের চাহিদা সংক্রান্ত ভুল অনুমান, যার কারণে বছরের পর বছর ধরে কেবল প্রয়োজনের তুলনায় সক্ষমতাই বেড়েছে, তা সংশোধন না করে সরকার এখন আগ্রাসীভাবে জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎখাতের বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচকে অনেক উপরে নিয়ে যাবে বলে শঙ্কা সিপিডির।
২০২০ থেকে ২০২৩ সাল, এই চার বছরে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৯২ শতাংশ, ইউনিটপ্রতি ৫ দশমিক ৯১ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৩৩ টাকা। ভবিষ্যতেও এই হারে বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, একই সঙ্গে বাড়তে পারে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝাও।
দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ আইন (কুইক পাওয়ার সাপ্লাই অ্যাক্ট) পরিস্থিতিকে আরও সঙ্গীন করেছে। এই আইন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নিলাম ছাড়াই সরকারকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, পাশাপাশি এতে বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার প্রলোভনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদেরও আকৃষ্ট করা হয়েছে।
সিপিডির যুক্তি হচ্ছে, বিশেষজ্ঞদের উপদেশ অনুযায়ী নবায়নযোগ্য শক্তির বিস্তার ঘটালে সরকারকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন পড়তো না। এখন মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৩ শতাংশের মতো নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে আসে। শুধু বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি বন্ধ করা যাবে বলেও মনে করছে না তারা।
গত বছর জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে তিন দফা বিদ্যুতের বিল বাড়ানো সত্ত্বেও ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ৪৩৫ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন টাকা গ্রস লোকসান হয়েছে বলে জানা গেছে, যার জন্য ৩৯৫ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন টাকা ভর্তুকি লেগেছে। পিডিবি ধারণা করেছিল, ২০২৩ সালে তাদের মোট লোকসানের পরিমাণ ৬ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকার মতো হবে, কিন্তু হয়েছে ১১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ২০২২ এর সঙ্গে তুলনা করলে, এই লোকসানের পরিমাণ সাড়ে তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে।
শূন্য-ভর্তুকি পরিকল্পনা এবং গ্রাহকদের ওপর এর প্রভাব
যেসব প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে, তাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথাও আছে। কোনো ভর্তুকি দেওয়া লাগবে না, এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছাতে আইএমএফ যে দামের কথা ভাবছে, সেখানে যেতে আগামী ৫ বছর ধরে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১২ শতাংশ বাড়াতে হবে বলে সিপিডির এক হিসাবে উঠে এসেছে।
আইএমএফের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী বিদ্যুতের নতুন দাম সরকারের ৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি কমাবে। সিপিডির হিসাবে, চড়ামূল্যে এলএনজি আমদানির কারণে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিতে ফার্নেস অয়েল ও কয়লারও বড়সড় ভূমিকা আছে।
২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এলএনজি আমদানি ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশ এক দশমিক ৬৬ লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে। গত বছর এক ঘনমিটার গ্যাস পেতে আমাদের ৭৯ টাকার বেশি খরচ হয়েছে, অথচ সরকার তা বিক্রি করেছে মাত্র ১৪ টাকায়।
“বিদ্যুতের ওভারক্যাপাসিটিকে (উৎপাদনের তুলনায় অনেক বেশি সক্ষমতা) সমন্বয় করা এবং আমদানিকৃত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোয় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত,” বলেছেন সিপিডির গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
ধীরে ধীরে জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসা, ক্যাপাসিটি চার্জের বিধান বাতিল করা, স্বল্প মাত্রায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বন্ধ জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রের স্থলে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে স্থান করে দিয়ে ভর্তুকির বোঝা কমানো সম্ভব, ভাষ্য সিপিডির। তাদের প্রস্তাব হচ্ছে, শূন্য-ভর্তুকি পরিস্থিতিতে পৌঁছাতে সরকার আগামী ৫ বছর ধরে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ রাখতে পারে।
নবায়নযোগ্য শক্তির ‘সম্ভাবনা ক্ষীণ’
সিপিডি বলছে, নানান উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে পরিকল্পনা, তাতে ২০২৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্যের স্থান ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ করা গেলে ৮ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা বাঁচানো যাবে, আর ২০৪১ সালের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ করা গেলে বাঁচবে ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
যদি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রের জায়গা নিয়ে নেয়, তাহলে আগামী ৫ বছর বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে রাখলেই ভর্তুকিশূন্য পরিস্থিতিতে পৌঁছানো সম্ভব, কেবল তা-ই নয় উল্টো ৩১ দশমিক ৮ কোটি টাকা লাভও করা যাবে, অনুমান গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির।
এমন সম্ভাবনা থাকার পরও অল্প খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথে হাঁটার ব্যাপারে বাংলাদেশের খুব একটা আগ্রহ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞা দেখা যাচ্ছে না। সমন্বিত বিদ্যুৎ-জ্বালানি মহাপরিকল্পনায় (আইএমপিএমপি) বাংলাদেশ এমনকি হাইড্রোজেন শক্তি, অ্যামোনিয়া কো-ফায়ারিং ও কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তিকেও স্থান দিয়েছে, বিশেষজ্ঞরা যেগুলোকে অপরীক্ষিত বলছেন। শেষ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারলেও এই প্রযুক্তিগুলো অনেক বেশি ব্যয়বহুল হবে, মত তাদের।
সিপিডি বলছে, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর অত্যধিক নির্ভরতার সমস্যা হচ্ছে, এটি নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের সম্ভাবনা ক্রমশ ফিকে করে দিচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে বিনিয়োগকারীদেরকে টেকসই ভবিষ্যৎ তথা নবায়নযোগ্য শক্তির অগ্রযাত্রায় বিনিয়োগ করার জন্যও আহ্বান জানিয়েছে তারা।