বাংলাদেশ যেহেতু তার জ্বালানি সরবরাহ বাড়াচ্ছে, তখন এর নেতাদের কাছে একটি সুযোগ হয়েছে: তারা কি জীবাশ্ম জ্বালানীর আমদানি দ্বিগুণ করবে, নাকি এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ করবে?
এই মতামত সম্পাদকীয়টি ১২ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে ডেইলি স্টারে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
সাইমন নিকোলাস
২১শে মার্চ, ২০২২ তারিখে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের শতভাগ বিদ্যুৎ কভারেজের আওতায় আনার ঘোষণা করেন। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি দেশ হিসাবে, বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য একটি গ্রিড প্রয়োজন, তাই এটি একটি মাইলস্টোন সময়।
গত বছর, বাংলাদেশ একটি বড় পদক্ষেপ নেয়, যখন সরকার ১০টি নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিকল্পনা বাতিল করে। তবে এখনও কিছু প্রত্যাশা রয়েছে যে অন্তত কিছু বাতিল কয়লাভিত্তিক প্রকল্প এলএনজি-চালিত বিদ্যুৎ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে।
একটি স্বতন্ত্র সম্ভাবনা রয়েছে যে নতুন ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টার প্ল্যান (আইইপিএমপি) বর্তমানে জাপান দ্বারা তৈরি করা হচ্ছে যা এলএনজি-চালিত শক্তির প্রতি আরও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে৷ এটিই মোটেও আশ্চর্যজনক হবে না, কারন জাপান তার এলএনজি পাওয়ার প্রযুক্তি বিদেশে বিক্রি করতে আগ্রহী।
জীবাশ্ম জ্বালানি বাজারের উপর একটি ঘনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি রাখলে দেখা যায় যে এই পদ্ধতির প্রধান অর্থনৈতিক ঝুঁকি রয়েছে এবং একটি সাশ্রয়ী এবং নির্ভরযোগ্য শক্তি ব্যবস্থার প্রয়োজন এমন একটি দেশের জন্য একটি পশ্চাদমুখী পদক্ষেপ হবে।
এলএনজি আমদানির উপর নির্ভরশীলতার অর্থ হল একটি অস্থিতিশীল বাজারে আটকে পরা এবং এর সাথে মূল্য বৃদ্ধি। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের আগেও এশিয়ান এলএনজির দাম গত বছরের শেষের দিকে তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। জাপান ভালো করেই জানে যে এই ধরনের এলএনজির দাম বৃদ্বি কীভাবে বিদ্যুতের দামকে প্রভাবিত করে—২০২১ সালে ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পর থেকে জাপানে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সংকটের খারাপ আবস্থা দেখা দিয়েছে, যা কিনা উচ্চ এলএনজি দামের কারণে।
এখন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের অর্থ হল জীবাশ্ম জ্বালানির বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। যে দেশগুলি সাধারণত রাশিয়া উপর গ্যসের জন্য নির্ভরশীল ছিল, তাদের এখন সরবরাহ চাপের কারনে অন্যত্র উৎস খুঁজতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে, এটি এলএনজির দাম নতুন রেকর্ড উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
গ্যাসের এই গ্লোবাল অবস্থা বাংলাদেশের মানুষ, ব্যবসা এবং সরকারের জন্য আকাশছোঁয়া খরচে পৌঁছেছে। সরকার ইতিমধ্যেই ২০২১ সালে বিপুল মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা কমানোর জন্য ভর্তুকি এবং অন্যান্য লোকসানের পরিশোধের ব্যবস্থা করেছে। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) বিদ্যুতের দাম ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে – যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা কিনা ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের কাছেও, অন্তত আংশিকভাবে পৌঁছাবে।
এলএনজি উপর নির্ভরতার আরও বুঝায় যে, বাংলাদেশ ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানী আমদানির ঝুঁকির মধ্যে আরও আটকে যাবে। এটি বৃদ্ধির কোন ভিত্তি হতে পারে না।
পরিবর্তে, সরকারের প্রচেষ্টা হওয়া উচিত, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার স্থায়িত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় দুটি জিনিসের দিকে পুনঃনির্দেশিত করা: গ্রিড বিনিয়োগ মাধ্যমে বিদ্যমান ক্ষমতার আরও ভাল ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং নবায়নযোগ্য শক্তির প্রবৃদ্ধি করা।
পাওয়ার সিস্টেমের ইতিমধ্যেই সামগ্রিক ব্যবহারের খুব কম, মাত্র ৪২ শতাংশের ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে, নতুন আইইপিএমপি অবশ্যই নির্ভরযোগ্য গ্রিড বিনিয়োগে মনোযোগ দিতে হবে এবং ব্যয়বহুল, আমদানি করা জীবাশ্ম জ্বালানির উপর দেশের ভবিষ্যত নির্ভরতা সীমিত করতে হবে।
ওভার ক্যাপাসিটি সমস্যা মানে পিডিবি প্লান্টের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট প্রদানে বাধ্য হচ্ছে, যার ফলে সরকারের জন্য অপারেটিং লোকসান আরও বাড়ছে। ট্রান্সমিশন সিস্টেমে বিনিয়োগ করলে বাংলাদেশের যেসব অংশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ প্রয়োজন সেখানে বিদ্যুৎ পাবে এবং পিডিবি থেকে আর্থিক ক্ষতির পরিমান বন্ধ করতে সাহায্য করবে। এটি ঠিক করা তাই আইইপিএমপি-র একটি অগ্রাধিকার হওয়া উচিত – ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি নয়।
নবায়নযোগ্য শক্তি একটি নিরাপদ উৎস, এবং সেই কারণেই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলি এখন বর্তমান ভূ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যেও নবায়নযোগ্য শক্তিতে তাদের বিনিয়োগকে ত্বরান্বিত করছে। জার্মানির কথাই ধরুন, যেটি ইউক্রেনের যুদ্ধের কারনে বৃদ্বিকৃত গ্যাসের খরচ এবং নিরাপত্তাহীনতার মাঝেও শতভাগ নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে তার যাত্রা ত্বরান্বিত করার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশে একটি আরও দিন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ না করার মানে হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য অর্থ প্রদানের আরেকটি দিন বাড়ছে – যখন তার দোরগোড়ায় প্রায় সীমাহীন শক্তির উৎস রয়েছে।
বাংলাদেশ যে শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তার অর্থ হচ্ছে নাগরিকদের জন্য আরও নির্ভরযোগ্য শক্তির ব্যবস্থা। ইউএসএআইডির একটি প্রতিবেদনে হাইলাইট করা হয়েছে যে গ্রিড-সংযুক্ত ঘরগুলির মাত্র ১১ শতাংশই দিনে ১৬ ঘন্টার বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ পায়। নিরাপদ নবায়নযোগ্য শক্তিই পারে বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানি মূল্যের অস্থিরতার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে একটি নির্দিষ্ট খরচে ব্যবসা এবং বাড়িতে নির্ভরযোগ্য শক্তি প্রবাহের মাধ্যমে এর সমাধান দিতে।
বাংলাদেশের টেকসই এবং নবায়নযোগ্য শক্তি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) সম্প্রতি প্রস্তাব করেছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ (নবায়নযোগ্য এবং পারমাণবিকসহ) একটি নতুন পরিচ্ছন্ন শক্তির লক্ষ্যমাত্রা নতুন আইইপিএমপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা ১০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতকে টার্গেট করবে, যার মধ্যে ৫,০০০ মেগাওয়াট বায়ু শক্তি রয়েছে।
অন্যান্য দেশগুলি জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। তারা ভবিষ্যতের শক্তি বাজারের জন্য পরিকল্পনা করছে – গত শতাব্দীর নয়। সাম্প্রতিক জীবাশ্ম জ্বালানীর অস্থিরতা শুধুমাত্র সেই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করবে।
যদি এর নতুন আইইপিএমপি বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ, শক্তি-সুরক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে চায়, তবে এটি গ্রিড আপগ্রেড এবং পরিষ্কার, সাশ্রয়ী এবং সার্বভৌম পরিচ্ছন্ন জ্বালানীতে বিনিয়োগ করবে। তার মানে নবায়নযোগ্য, এলএনজি আমদানি নয়।
সাইমন নিকোলাস ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) এর একজন জ্বালানী অর্থনীতি বিশ্লেষক।