নিউজলেটার

EN

জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানিতে নির্ভরতায় লোডশেডিংয়ে বাংলাদেশে তাপদাহ আরও বাড়ছে

গত বছরের প্রচণ্ড তাপদাহ এবারও ফিরে এসেছে, সপ্তাহ দুয়েক ধরে বাংলাদেশের বিশাল এলাকাজুড়ে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে, ঘর ঠাণ্ডা রাখতে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা।

ইমরান হোসেন

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় এরইমধ্যে তিন হাজার তিনশ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে

ধানক্ষেতে সেচ দিতে, মাছচাষের ক্ষেত্রে সঠিক পানির স্তর বজায় রাখতে এবং পোল্ট্রি ফার্মগুলো ঠাণ্ডা রাখতেও বিদ্যুতের দরকার হয়; এই পোল্ট্রি ফার্মগুলোতে এখন প্রতিদিন হাজার হাজার হাঁস-মুরগির মৃত্যু হচ্ছে, যার কারণ সম্ভবত হিটস্ট্রোক।

মানুষজনও ভুগছে, বিশেষ করে দরিদ্ররা; তপ্ত সূর্যের নিচে হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে বাড়ি ফেরার পর নিয়মিত লোডশেডিং দেখছে শহর-গ্রামের সবাই। এরই মধ্যে তাপপ্রবাহে বা এ সংশ্লিষ্ট উপসর্গ নিয়ে অন্তত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই খেটে খাওয়া মানুষ। অনেকেই কৃষক। শিশু-বৃদ্ধসহ শত শত মানুষ ডায়রিয়া, নিউমোনিয়ার মতো গরমজনিত রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

এরপরও একে মহাসংকটের কেবল সূচনা বলেই মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। তারা সাবধান করে বলছেন, চলমান তাপপ্রবাহ সহজে শেষ হচ্ছে না; এখানেই শেষ নয়, এ ধরনের তাপপ্রবাহ মে এবং তার পরের মাসগুলোতেও দেখা যাবে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সময় যত গড়াবে তাপপ্রবাহের সংখ্যা ও তীব্রতা আরও বাড়তে থাকবে। আর এই তীব্র গরম মোকাবেলায় পর্যাপ্ত বিদ্যুতের সরবরাহই জনসাধারণকে ঠিকঠাক প্রস্তুত রাখতে পারে।

বাংলাদেশ চাইলে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে বিনিয়োগ করে সহজেই এ ধরনের পরিস্থিতির তীব্রতা কমিয়ে আনতে পারতো। তা না করে দেশটি জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ করেছে; দেশ-বিদেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে আমদানিকৃত জ্বালানির ওপর ভর করে শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বিদ্যুৎ খাতে ২৪ বছরেরও বেশি সময় এবং তিন হাজার তিনশ কোটি ডলার খরচ করার পর বাংলাদেশ এখন এমন এক জটিল সমস্যায় পড়েছে যে, জ্বালানি ঘাটতির কারণে দেশটি তার ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেককেও কাজে লাগাতে পারছে না।

গ্রামে বিদ্যুতের তীব্র সংকট

“ব্যাপক গরমের কারণে আমার ১১টি ছাগল আর তিনটি ভেড়া মরে গেছে,” বলেছেন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের শিয়ালখোয়া গ্রামের খামারি সোলায়মান।
একই এলাকার পোল্ট্রি ব্যবসায়ী শাহ আলী কেবল ১১ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিলের গরমেই দেড়শর বেশি মুরগির মৃত্যু দেখেছেন।

শিয়ালখোয়ার মতো অসংখ্য গ্রামে দিনে এখন ছয় থেকে ৮ বার লোডশেডিং দেখা যায়। প্রতিবার লোডশেডিং স্থায়ী হয় একঘণ্টা বা তারও বেশি। প্রচণ্ড গরমের হাত থেকে মুরগি বাঁচাতে অনেক পোল্ট্রি ব্যবসায়ী এখন তাদের খামারের ছাদের ওপর পাইপ বসিয়েছেন, খামারকে ঠাণ্ডা রাখতে ওই পাইপ থেকে নিয়মিত পানি ছিটানো হয়। কারণ, কৃষিবিদদের হিসাবমতে মুরগির খামার কখনোই ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি গরম থাকতে পারবে না।

পোল্ট্রি খামারগুলোর ভেতর সিলিং ফ্যানও আছে; মুরগি, বিশেষ করে যেগুলোর বয়স ৫ সপ্তাহের বেশি, সেগুলোর বেঁচে থাকার পরিবেশ বজায় রাখতে পর্যাপ্ত বায়ুচলাচল নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ ফ্যানগুলো সারাক্ষণ চালিয়ে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু তীব্র বিদ্যুৎ সঙ্কট এ সকল যাবতীয় প্রচেষ্টাকেই ব্যাহত করছে।

“বিদ্যুৎ না থাকলে ছাদ বা মুরগিগুলোর ওপর ছিটিয়ে দেওয়ার পানি নিচ থেকে ওপরে তোলার পাম্প এবং ফ্যান বন্ধ থাকে, তখন আমার করার কী থাকে,” বলেছেন নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁওর পোল্ট্রি খামার ভূইয়াঁ এগ্রোর সত্বাধিকারী সালাউদ্দিন ভূইয়াঁ সেলিম।

চরম আবহাওয়া গত ২০ এপ্রিল সেলিমের পোল্ট্রির ৮৭টি মুরগিকে মেরে ফেলেছে; সেদিন ৬৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ গরম দেখেছিল ঢাকা, তাপমাত্রা উঠেছিল ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। মুরগির মৃত্যুর খবর এসেছে যশোর এবং পাবনা থেকেও। এবারের তাপপ্রবাহে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এই দুই জেলায় টানা কয়েকদিন ধরেই দিনের তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি।

তাপদাহে যশোরের একটি পোল্ট্রি খামারে এক লাখের বেশি মুরগির মৃত্যু হয়েছে বলে খবরের কাগজে উঠে এসেছে। “আমার ধারণা এই গ্রীষ্ম ২০ হাজার পোল্ট্রি ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ করে দেবে, এদের প্রায় এক চতুর্থাংশ হয়তো চিরতরেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে,” বলেছেন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সুমন হাওলাদার।

জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং ফিড ও বাচ্চা মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় এমনিতেই উৎপাদন খরচ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের অনেকেই এখন ব্যবসায় আর নতুন কোনো বিঘ্ন হজম করতে পারবেন না।

উত্তরবঙ্গের মাছচাষীদের অবস্থাও ভালো না; তীব্র গরমে জলাশয়গুলো যেভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে, তাতে মাত্রা অনুযায়ী পানির স্তর রাখতেই গলদঘর্ম হতে হচ্ছে তাদের। সরকারের মৎস্য কর্মকর্তারা জলাশয়গুলোতে পানির গভীরতা ৫-৭ ফুট রাখার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। পানি কমে গেলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে কমে যেতে পারে, যার সুযোগে বিষাক্ত গ্যাসের মাত্রা বাড়তে পারে যা মাছের জন্য ভয়াবহ বিপদ নিয়ে আসবে।

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে রংপুরের কোথাও কোথাও দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এই লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় মাছচাষীরা ভূগর্ভস্থ পানিকে তুলে এনে জলাশয়গুলো পর্যাপ্ত পানি দিয়ে ভরে রাখতে পারছেন না। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশে যে প্রোটিন ও শস্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমবে, এসব দেখে তা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে।

তাপদাহ সবচেয়ে বেশি চোখ রাঙাচ্ছে বোরো উৎপাদনকে। প্রচণ্ড গরমে বিস্তৃর্ণ ধানক্ষেত শুকিয়ে গেলে বাংলাদেশের এই মূল খাদ্যশস্যের উৎপাদন নিয়ে ‍কৃষক বেশ বিপাকেই পড়বে। এর মধ্যেই বিদ্যুতের পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। গত ২৪ এপ্রিল লোডশেডিং বেড়ে প্রায় ১৫০০ মেগাওয়াটের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পর

সরকার কৃষকদেরকে নিজেদের ডিজেলচালিত পাম্প দিয়েই জমিতে সেচ দেওয়ার পরামর্শ দেয়। টানা তাপপ্রবাহের মধ্যে ধানক্ষেতে কৃষকরা সেচ না দিতে পারায় অনেক ক্ষেতেই ফাটল দেখা যাচ্ছে।

কৃষকদেরকে দেওয়া পরামর্শ এবং জ্বালানি সংক্রান্ত সরকারি হিসাব এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে যে- জ্বালানি সরবরাহ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা পুরোপুরি মেটাতে পারার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

নবায়নযোগ্যকে অবজ্ঞা করে ভুগতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন মোটাদাগে ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, যা অনুমানকৃত সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের চেয়ে অনেক কম। দ্রুত বাড়তে থাকা ঋণের কারণে বাংলাদেশ তার জীবাশ্ম জ্বালানি সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে পারে না, এ কারণে বিদ্যুতের সরবরাহও সহসা বাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। ভারী জ্বালানি তেলনির্ভর এবং কয়লা ও গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সরকারের কাছ থেকে বিপুল অর্থ পায়।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৯৭ শতাংশই জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর। যার ৪৪ শতাংশ গ্যাস, ২২ শতাংশ ফার্নেস অয়েল, ১৯ শতাংশ কয়লানির্ভর। ১০ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি, আর বাকি ২ শতাংশ ডিজেলনির্ভর।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বিদ্যুৎ খাতের এই ধরনের বিস্তারের ঘোরবিরোধী ছিলেন। তারা বলেছিলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা তৈরি হলে তা রাজনৈতিক অস্থিরতা বা দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট দামের ওঠানামার মতো নানান আঘাত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

কোভিড-১৯ মহামারীর আঘাত এবং ইউক্রেইনে রাশিয়ার হামলার পর জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের প্রত্যেকটি নেতিবাচক পূর্বানুমানই সত্যি হয়েছে। গত ১৪ বছরে বিদ্যুতের দাম ৩০০ শতাংশ বেড়েছে, কিন্তু সবার জন্য নির্ভরযোগ্য, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এখনও নিশ্চিত হয়নি।

পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, নিজেদের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ যে খাতকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছিল, সেই বিদ্যুৎ খাতই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে, যার দরুন শক্তিশালী সব তাপদাহও সৃষ্টি হচ্ছে।

গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন দ্বিগুণ হয়েছে, বেড়েছে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণও। কয়লা পোড়ানো এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কারণে স্থানীয়ভাবে হওয়া দূষণ এত মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে এটি কখনো কখনো সূর্যের আলোকেও ম্লান করে দিচ্ছে।

এতসবের পরও কোনোকিছুই বাংলাদেশকে হুঁশে ফেরাতে পারছে না। বাংলাদেশ এখনও সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব, নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ বেছে না নেওয়ার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংক্রান্ত মহাপরিকল্পনায় (আইপিএমপি) বাংলাদেশ গ্যাস ও কয়লার ওপর ২০৫০ সাল পর্যন্ত নির্ভরশীল থাকার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে।

একই মহাপরিকল্পনায় ভবিষ্যতে হাইড্রোজেন জ্বালানি, অ্যামোনিয়া কো-ফায়ারিং এবং কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি ব্যবহারের আগ্রহও প্রকাশ পেয়েছে, যেসব প্রযুক্তিকে বিশেষজ্ঞরা অপরীক্ষিত প্রযুক্তি অ্যাখ্যা দিয়ে আসছেন। যদি এসব প্রযুক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে উপযুক্ত বলে প্রমাণিতও হয়, তাহলেও সেগুলোর জন্য বিপুল খরচ করতে হবে। অন্যদিকে নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনাকে আইপিএমপিতে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

সব দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ভুগতেই যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বার্ষিক লোকসানের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় চারগুণ বেড়ে ১০৭.২ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। যে বছর বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মসনদে বসেছিল, সেই ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত বিপিডিবির বার্ষিক লোকসান ১৪ গুণ বেড়েছে। একই সময়ের ব্যবধানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাও সাড়ে ৫ গুণ বেড়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়নি। উল্টো আরও বেড়েছে।

Related Analysis

জ্বালানি সংক্রান্ত নীতিমালাগুলোর অসামঞ্জস্যই বাংলাদেশে নবানোযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণে বাধা

বাংলাদেশের জ্বালানি সংক্রান্ত নীতিমালাগুলোতে, বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা সংক্রান্ত দলিলপত্রে বিপুল অসঙ্গতি রয়েছে, যা

Read More »